কমা ও ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার
লিখিত বাক্যে ছেদ বা বিরাম বোঝানোর জন্য যেসব চিহ্ন ব্যবহার করা হয়, তাদের সাধারণত ছেদচিহ্ন বা বিরামচিহ্ন বলা হয়। বাক্যের অর্থ ঠিক ঠিক বোঝানোর জন্য বাক্যের মধ্যে এক বা একাধিক জায়গায় অল্প সময় কিংবা বেশি সময় থামার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া বাক্যের শেষে তো অবশ্যই থামতে হয়। এই থামার সাধারণ নাম বিরাম।
আমরা যখন কথা বলি, তখন একটি বাক্যের সবটুকু অংশ এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতে পারি না। ফুসফুসে বায়ু সঞ্চয়ের বা ফুসফুসকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য শ্বাসযন্ত্র মাঝে মাঝে থামে। তবে এই থামার মধ্যে রয়েছে একটি নিয়মের ধারাবাহিকতা। কেননা, না থেমে একনাগাড়ে বিরামহীনভাবে কথা বলে গেলে অর্থের বিপত্তি ঘটতে পারে। যেমন: 'তুমি ওখানে যেয়ো না গেলেই গণ্ডগোল হবে।'
বাক্যটিতে যে ভাব প্রকাশিত হয়েছে তা মূলত সেখানে গেলেই গণ্ডগোল হবে। কিন্তু বাক্যটিতে যদি প্রয়োজনীয় বিরামচিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাহলে অর্থটিই পাল্টে যায় তুমি ওখানে যেয়ো, না গেলেই গণ্ডগোল হবে।
আবার বিরামচিহ্ন অন্যভাবে বিন্যস্ত করলে অর্থের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে তুমি ওখানে যেয়ো না, গেলেই গণ্ডগোল হবে।
যেকোনো ভাষায় লেখ্য-রূপে বিরামচিহ্নের ব্যবহার অপরিহার্য। সুতরাং লেখার ক্ষেত্রে বক্তব্যকে যথাযথভাবে প্রকাশ এবং তার অর্থকে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপনের জন্য যেসব চিহ্ন ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে ছেদ বা বিরামচিহ্ন বলে। বিরামচিহ্ন বক্তব্যকে বা লেখার ভাষাকে বোধগম্য, সুস্পষ্ট ও সুবিন্যস্ত করে।
ছেদ বা বিরামচিহ্নের কাজ:
১. বাক্যে ব্যবহৃত পদগুচ্ছকে ভাব অনুসারে অর্থবহ করা।
২. বাক্যাংশ সংগ্রথিত ও পৃথক করা।
৩. বাক্যের সমাপ্তি নির্দেশ করা
১. কমা (,): কমা-কে বাংলায় পাদচ্ছেদ বলা হয়। কমার মূল কাজ পূর্ণ একটি বাক্যকে ভাবানুসারে একাধিক অংশে ভাগ করা। যেকোনো রচনায় দাঁড়ি (।) ছাড়া অন্য সব বিরামচিহ্নের মধ্যে কমার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। 'কমা' সংশ্লিষ্ট পদের পর নিচের দিকে ব্যবহৃত হয়। রচনার ধরন এবং ভাব পরিস্ফুটনে লেখকের আকাঙ্ক্ষার ওপরে কমার ব্যবহার নির্ভরশীল।
কমা (,)-র বিরতিকাল ১ (এক) বলতে যতটুকু সময় প্রয়োজন ততটুকু পরিমাণ।
কমা (,) ব্যবহারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য
১. বাক্যে অর্থ-বিভাগ দেখাবার জন্য যেখানে স্বল্প বিরতির প্রয়োজন, সেখানে কমা ব্যবহৃত হয়। যেমন: উন্নতি চাও, উন্নতি পাবে পরিশ্রমে।
২. বাক্যে একই পদবিশিষ্ট একাধিক শব্দ পাশাপাশি ব্যবহৃত হলে শেষ পদটি ছাড়া বাকিগুলোর মধ্যে এক বা একাধিক কমা ব্যবহার করে একজাতীয় পদকে পৃথক করা হয়। যেমন: বিশেষ্য পদের পরে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আত্মোৎসর্গ করেছেন।
৩. একজাতীয় একাধিক বাক্য বা বাক্যাংশ পাশাপাশি ব্যবহৃত হলে কমা ব্যবহার করে তাদের আলাদা করতে হয়। যেমন: হিমেল ঘরে ঢুকল, বইপত্র রাখল, জামাকাপড় ছাড়ল, তারপর বিশ্রাম নিল।
৪. প্রত্যক্ষ উক্তির পূর্বে কমা বসে। যেমন: সুনীল বলল, 'আমার বাবা বাড়ি নেই।'
৫. সম্বোধন পদের পরে কমা বসে। যেমন: বিশাখা, এদিকে এসো।
৬. জটিল বাক্যের অন্তর্গত প্রত্যেক খণ্ডবাক্যের পরে 'কমা' বসে। যেমন যাদের বুদ্ধি নেই, তারাই কেবল এ কথা বিশ্বাস করে।
৭. উপাধিক্রমের মধ্যে 'কমা' ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কারো নামের শেষে একাধিক ডিগ্রি থাকলে কমা বসে। যেমন: ফয়সাল আহমেদ, এমএ, পিএইচডি।
কমার উদাহরণ:
বিশেষণ পদের পরে কমার উদাহরণ: সৎ, বিনয়ী, অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী ছাত্ররাই জীবনে সাফল্য লাভ করে।
সর্বনাম পদের পরে কমার উদাহরণ: তুমি, আমি, সে-আমরা তিনজনই ঢাকা যাব।
ক্রিয়াপদের পরে কমার উদাহরণ এলেন, দেখলেন, চলে গেলেন।
২. ঊর্ধ্বকমা ('): যতগুলো বিরামচিহ্ন আছে, তন্মধ্যে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী বিরামচিহ্ন। ঊর্ধ্বকমা পদের মধ্যবর্তী কোনো একটি বর্ণের ওপরে জায়গা দখল করে নেয়। ঊর্ধ্বকমার কোনো বিরতিকাল নেই। এই চিহ্নকে 'ইলেক' বা 'লোপচিহ্ন' নামে অভিহিত করা হয়। ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার বর্তমানে খুবই কমে গেছে। তবে পুরনো বাংলা রচনায়, বিশেষত ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের সংক্ষিপ্ত-রূপে ব্যাপক হারে ঊর্ধ্বকমা ব্যবহৃত হতো। নিচে ঊর্ধ্বকমা ব্যবহারের কতিপয় ক্ষেত্র উদাহরণসহ দেখানো হলো।
১. ঊর্ধ্বকমার পুরনো ব্যবহার সম্পর্কে বলা প্রয়োজন যে, বাংলা ভাষার সাধুরীতির ক্রিয়া, সর্বনাম এবং কিছু সংখ্যাশব্দে চলিতরীতির সংক্ষিপ্ত-রূপ নির্দেশ করতে ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার হতো। যেমন:
ক্রিয়ার উদাহরণ:
সাধুরীতি (ক্রিয়ার দীর্ঘরূপ) | চলিতরীতি (ক্রিয়ার সংক্ষিপ্তরূপ) |
হইতে | হ'তে |
উপরে | 'পরে |
করিয়াছি | ক'রেছি |
সর্বনামের উদাহরণ:
সাধুরীতি (সর্বনামের দীর্ঘরূপ) | চলিতরীতি (সর্বনামের সংক্ষিপ্তরূপ) |
তাহার | তা'র |
তাহাদের | তা'দের |
সংখ্যাশব্দের উদাহরণ:
সাধু সংখ্যাশব্দের পূর্ণরূপ | চলিত সংখ্যাশব্দের রূপে ঊর্ধ্বকমা |
দুইটি | দু'টি |
একশত | একশ' |
২. অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বকমা : অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে অর্থবিভ্রান্তি ঘটার আশঙ্কা থাকলে সে ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বকমার ব্যবহার হয়। যেমন: 'তুমি কেমন ক'রে গান করো হে গুণী।'
৩. অব্দসংখ্যা সংক্ষেপণে ঊর্ধ্বকমা : কিছুসংখ্যক অব্দসংখ্যা বিভিন্ন কারণে এতটাই তাৎপর্য মণ্ডিত ও সুপরিচিত থাকে যে বাক্যের মধ্যে তা পুরোটা না লিখলেও বোঝানো যায়। যেমন:
'৫২-র ভাষা আন্দোলন। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ।
বিরামচিহ্ন প্রয়োগের কতিপয় নমুনা
১. রে পথিক রে পাষাণ হৃদয় পথিক কী লোভে এত এস্তে দৌড়াইতেছ কী আশায় খণ্ডিত শির বর্শার অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া লইয়া যাইতেছ এ শিরে হায় এ খণ্ডিত শিরে তোমার প্রয়োজন কী
বিরামচিহ্নের প্রয়োগ:
রে পথিক! রে পাষাণ হৃদয় পথিক! কী লোভে এত এস্তে দৌড়াইতেছ? কী আশায় খণ্ডিত শির বর্শার অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া লইয়া যাইতেছ? এ শিরে হায়! এ শিরে তোমার প্রয়োজন কী?
২. আমি প্রথমে তাহাকে চিনিতে পারিলাম না তাহার সে ঝুলি নাই তাহার সে লম্বা চুল নাই তাহার শরীরে পূর্বের মতো সে তেজ নাই অবশেষে তাহার হাসি দেখিয়া তাহাকে চিনিলাম কহিলাম কি রে রহমত কবে আসিলি?
বিরামচিহ্নের প্রয়োগ:
আমি প্রথমে তাহাকে চিনিতে পারিলাম না। তাহার সে ঝুলি নাই, তাহার সে লম্বা চুল নাই, তাহার শরীরে পূর্বের মতো সে তেজ নাই। অবশেষে তাহার হাসি দেখিয়া তাহাকে চিনিলাম। কহিলাম, "কি রে রহমত, কবে আসিলি?"
৩. যে শব্দকে ভালোবাসে খুব শব্দকে আদর করে করে যে খুব সুখ পায় সে-ই হতে পারে কবি কবিরা গোলাপের মতো সুন্দর সুন্দর কথা বলেন চাঁদের মতো স্বপ্ন দেখেন তুমিও গোলাপের মতো সুন্দর কথা বলতে চাও চাঁদের মতো স্বপ্ন দেখতে চাও তোমার যদি শব্দের জন্যে আদর-ভালোবাসা না থাকে তাহলে পারবে না তুমি গোলাপের মতো লাল গন্ধভরা কথা বলতে চাঁদের মতো জ্যোৎস্নাভরা স্বপ্ন দেখতে
বিরামচিহ্নের প্রয়োগ:
যে শব্দকে ভালোবাসে খুব, শব্দকে আদর করে করে যে খুব সুখ পায়, সে-ই হতে পারে কবি। কবিরা গোলাপের মতো সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, চাঁদের মতো স্বপ্ন দেখেন। তুমিও গোলাপের মতো সুন্দর কথা বলতে চাও, চাঁদের মতো স্বপ্ন দেখতে চাও? তোমার যদি শব্দের জন্যে আদর-ভালোবাসা না থাকে, তাহলে পারবে না তুমি গোলাপের মতো লাল গন্ধভরা কথা বলতে, চাঁদের মতো জ্যোৎস্নাভরা স্বপ্ন দেখতে।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন: (নমুনা)
১। বিরাম চিহ্নের কাজ হলো-
i. বাক্যকে ভাব অনুসারে অর্থবহ করা
ii. বাক্যাংশ সংগ্রথিত ও পৃথক করা
iii. বাক্যের সমাপ্তি নির্দেশ করা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
১। প্রদত্ত বিরামচিহ্নগুলোর 'আকৃতি' ও বিরতিকাল নিচের ছকে লিপিবদ্ধ কর:
বিরামচিহ্ন | আকৃতি | বিরতিকাল |
কমা | ||
সেমিকোলন | ||
দাঁড়ি | ||
কোলন | ||
ড্যাশ | ||
হাইফেন | ||
প্রশ্নবোধক চিহ্ন | ||
বিস্ময়চিহ্ন | ||
ধাতু দ্যোতক চিহ্ন |
common.read_more